মা-বাবার এই আচরণগুলো শেষ করে দিতে পারে সন্তাদের ভবিষ্যৎ
Image: google

মা-বাবার এই আচরণগুলো শেষ করে দিতে পারে সন্তাদের ভবিষ্যৎ!

পৃথিবীতে অনেক কঠিন কাজ আছে, তার মধ্যে অন্যতম কঠিন একটি কাজ হলো সন্তান লালন-পালন। সন্তানের বেড়ে ওঠা এবং যাবতীয় আবদার মেটাতে অধিকাংশ বাবা-মা ব্যতিব্যস্ত থাকেন। তাদের দু’চোখ জুড়ে থাকে স্বপ্নের খনি- তাদের সন্তান বড় হয়ে একদিন তাদের সেই

স্বপ্ন পূর্ণ করবে, সমাজে তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেবে। এত যখন পরিকল্পনা, তখন সন্তানের ভালোর জন্য চাই বাড়তি যত্ন। তার খাওয়াদাওয়া, ঘুম, স্বাস্থ্য, পড়ালেখা, বিয়েশাদি- সে এক মহাযজ্ঞের আয়োজন যেন! সব মা-বাবাই চান, তার সন্তানের পরবর্তী জীবনে সুখ আর সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক। কিন্তু পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক, মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলোও সন্তানের বেড়ে ওঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে

কাজ করে। তাই অনেক সময় দেখা যায়, বাবা-মার সীমাহীন যত্ন আর দেখভাল সত্ত্বেও, অনেক শিশুই বড় হয়ে ব্যক্তিগত জীবনে তেমন সফলতা পায় না। আবার প্রচণ্ড অভাব-অবহেলার মধ্যে জন্ম নিয়েও, বহু ছেলেমেয়ে একসময় নিজের ক্ষুদ্র গণ্ডি পেরিয়ে বড় সফলতার দেখা পায়। তবে কি বাবা-মার যত্নআত্তির কোনো ভূমিকাই নেই সন্তানের বিকাশে? অবশ্যই আছে, কিন্তু শিশুর প্রতি প্রতি বাবা-মায়ের দৈনন্দিন কিছু

ভুল আচরণের কারণে সেই যত্ন যেতে পারে বিফলে, সন্তানের জীবন হতে পারে ব্যর্থতামণ্ডিত। চলুন তবে জেনে নিই, এমন কিছু ভুল আচরণ সম্পর্কে।

১. কর্তৃত্ব ফলানো: কোনো বাবা-মায়ের ইচ্ছা থাকে না যে, তার সন্তান বড় হয়ে ব্যর্থ একজন মানুষে পরিণত হোক। তারা সবসময়ই চান, তাদের সন্তানটি নিরাপত্তা পেয়েই বড় হোক। কারণ, সামনে তার পুরো একটা ভবিষ্যত পড়ে আছে। নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা ভালো, বিশেষ করে আপনার সন্তান যখন শিশু। তখন সত্যিকার অর্থেই বাড়তি নিরাপত্তার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সন্তান যখন ক্রমাগত বড় হতে থাকে, তখন তার নিরাপত্তা নিয়ে আগের মতো ভাবার কিছু থাকে না। এটা একটা ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ, কারণ সে যত বড় হয়ে ওঠে, ততই নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারগুলো বুঝে নিতে শেখে। একটা ছোট বাচ্চা আগুন দেখলে হয়তো এগিয়ে যেতে পারে, কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে সে বুঝে নেবে,

আগুন তার জন্য বিপদজনক। আপনি তখন বলে দিতে হবে না যে, আগুনে বিপদ আছে! ভারসাম্য ব্যাপারটা এভাবেই গড়ে ওঠে। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, ছোটবেলায় বাবা-মায়েরা নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সন্তানদের যেভাবে নজরবন্দী রাখতেন, সন্তান বড় হওয়ার পরও তাদের সেই আচরণ রয়ে যায়। সে কী করবে না করবে, কার সঙ্গে মিশবে, কী খাবে-না খাবে, কী পোশাক পরবে-না পরবে- এরকম শত ব্যাপার নিয়ে তারা মেতে থাকেন। এটা সহনীয় মাত্রায় প্রয়োজনীয়। কিন্তু অনেক বাবা-মা ‘নিরাপত্তা’র নামে সন্তানের ব্যক্তিগত জীবনেও হস্তক্ষেপ শুরু করেন। তারা বুঝতে চান না, তাদের সন্তান বড় হচ্ছে। তার নিজস্বতা বলে কিছু একটা গড়ে উঠছে, নিজের কিছু স্বপ্ন তৈরি হচ্ছে, হয়তো নিজের মতো জীবনের লক্ষ্যও রয়েছে তার। কিন্তু কথিত নিরাপত্তার নামে আপনি সন্তানের ভবিষ্যতকে দুর্বিষহ করে দিচ্ছেন না তো? টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১১ সালের এক সমীক্ষায় দেখিয়েছে, ছোটবেলা পার করার পরও যেসব শিশু কড়া নিরাপত্তার চাদরের ভেতর রয়ে যায়, তারা

পরবর্তী জীবনে আত্মকেন্দ্রিক, অত্যধিক সচেতন, অল্পতেই ভেঙে পড়ার মতো পর্যায়গুলো পার করে। ছোট থেকে সিদ্ধান্ত নেয়ার মানসিকতা গড়ে না ওঠায় সে পদে-পদে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। স্বকীয়তা এবং আত্মনির্ভরশীলতার মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটো ব্যাপার তার ভেতর অনুপস্থিত থেকে যায়। অন্যদের মতো তার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস থাকে না। যেগুলো তার পুরো জীবনকে প্রভাবিত করে। অথচ প্রয়োজন ছিল, কীভাবে তার নিজের সিদ্ধান্তগুলো নিজে নিতে পারে- সেটা শেখানো। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে কীভাবে আরও ফলপ্রসূ করে তোলা যায়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মূল্যবোধের চর্চা তার ভেতর গেঁথে দেওয়া। তাহলেই সন্তান নিজের অবস্থান থেকে একজন পরিপূর্ণ সফল মানুষ হয়ে ওঠার শক্তি পাবে সবসময়।

২. বকাঝকা এবং অভিশাপ: শিশু সন্তানকে বকাঝকা করা আমাদের সমাজে খুবই প্রচলিত একটি চিত্র। এটা সত্যি যে, বাবা-মা সন্তানের ভালো চান বলেই সন্তানের কর্মকাণ্ড নিয়ে চিন্তিত হন। ছোট অবস্থায় তারা দুষ্টুমি করবেই, তাদের তাদের প্রকৃতি বা খেলাধুলার ধরনই এমন। তাই মাঝেমাঝে তারা হয়তো এমন কিছু করে বসে, যা আপনার সহ্যের সীমাকে ছাড়িয়ে যায়। আপনি দ্বিতীয়বার না ভেবে বলে বসেন, “অনেক হয়েছে; আজ তোর একদিন কি আমার একদিন”! এই বলে যা বলার বলে ফেলেন! অনেক বাবা-মায়ের বদভ্যাস হচ্ছে একটু এদিক-ওদিক হলেই সন্তানকে অভিশাপ দিয়ে বসেন। এটা খুবই বাজে একটি ব্যাপার। আপনিই সন্তানের ভালো চান, আবার রেগে গিয়ে বলছেন, “তুই

জীবনে কিছু করতে পারবি না”! সন্তানকে বকাঝকা করলে সে আরও একগুঁয়ে হয়ে যেতে পারে; মূলত শিশু সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের আচরণের ধরনই সন্তান ভবিষ্যতে কেমন হবে, সেটা অনেকাংশে নির্ধারণ করে দেয়। সন্তানকে বকা দেয়া যেতেই পারে। কিন্তু তাকে শুধরে দেয়ার মন-মানসিকতা থেকে বকা দিচ্ছেন, নাকি কর্তৃত্ব ফলাতে বকা দিচ্ছেন- সেটা ভেবেছেন কখনো? আপনার উচ্চারিত শব্দগুলো তাকে শুধরে না দিয়ে আরও একগুঁয়ে করে দিতে পারে, আপনার সাথে সন্তানের মানসিক দূরত্ব তৈরি করতে পারে, তার ভেতর পরামর্শ না নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করে দিতে পারে। গবেষণায়ও এমন ব্যাপারগুলো বারবার উঠে এসেছে।

৩. মারধোর করা: সন্তানকে শাসন করার অসংখ্য উপায় থাকতে পারে। কিন্তু শাসনের নামে গায়ে হাত তোলা আপনার শিশুর জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। উন্নত বিশ্বে শিশুদের শিষ্টাচার শেখানো, পড়াশোনায় মনোযোগী করে তোলা, বাবা-মায়ের অনুগত করে গড়ে তোলার জন্য দারুণ সব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। শিশু যদি কথা না শুনতে চায়, তবে তার চাহিদার কথা শুনে নেওয়া জরুরি। রোগী যেমন, তাকে ওষুধও দিতে হবে তেমন। তার মানে এই নয় যে, তাকে পিটিয়ে হলেও মানাবেন। শিশুরা শারীরিক গঠনে এমনিতেই দুর্বল, তাই অল্প গায়ে হাত তোলাতেও গুরুতর শারীরিক জখমের আশঙ্কা যেমন থাকে; তেমনি প্রহারজনিত কারণে শিশুর মানসিক জগতেও আসে বড় ধরনের আঘাত। একটা সময় দেখবেন, আপনার শিশু তার ব্যাপারগুলো আপনার কাছে প্রকাশ করছে না, যেগুলো স্বাভাবিকভাবে আপনাকেই জানানোর কথা।

আপনি হয়তো পরিবর্তনগুলো খেয়াল করছেন না। কিন্তু সে তার মনোজগতের এই বিশাল পরিবর্তন বয়ে বেড়াবে ভবিষ্যত পর্যন্ত। তার কল্পনার জগতে আপনিই হয়ে যেতে পারেন সত্যিকার ভিলেন। ভালো-মন্দ যাচাই করার মতো খুব দক্ষ শিশুরা হয় না, সেটা আপনাকেই শেখাতে হবে। আর তখনই তাকে শেখাতে পারবেন, যখন আপনি সন্তানের কাছে নির্ভরতার প্রতীক হতে পারবেন।টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা প্রায় ৫০ বছরের গবেষণায় প্রায় দেড় লক্ষ শিশুর ওপর গবেষণা করে দেখেছেন, যেসব শিশুদের শারিরীকভাবে শাস্তি দেওয়া হতো, তারা পরবর্তীতে পরিবেশ, পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে তেমন সফল হয়নি। তাছাড়া পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে অবসাদ, ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও রয়েছে প্রচুর।

৪. ইলেকট্রনিক পণ্য ব্যবহারে অসচেতনতা: যেসব বাবা-মায়েরা ইলেকট্রনিক জিনিসের প্রতি বেশি আসক্ত, তাদের সন্তানদের ভেতর পরবর্তীতে মানসিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারা, অমনোযোগিতা, আলস্য- এসব শিশুদের ভেতর জেঁকে বসে। বাবা-মায়েরা শিশুকে যথেষ্ট সময় না দিলে তাদের কথা শিখতে দেরি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশুদের বাবা-মায়েরা টিভি, স্মার্টফোনে আসক্ত, তাদের সন্তানের ভাষাগত দক্ষতা গড়ে উঠতে তুলনামূলক বেশি সময় লাগে। বাবা-মার ফোন বা ইলেকট্রনিক পণ্যে আসক্তি

সন্তানের উপর ফেলতে পারে বিরূপ প্রভাব কেবল বাবা-মা এগুলো থেকে দূরে থাকলেই হবে না, নিশ্চিত করতে হবে, সন্তানও যাতে এগুলা থেকে দূরে থাকে। বিশেষ করে বয়স দু’ বছর না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে টিভি, স্মার্টফোন-এগুলো থেকে দূরে রাখতে হবে। বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণ থেকেও বাচ্চাদের দূরে রাখতে হবে, কারণ তাদের অসুগঠিত মস্তিষ্ক এতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ভাষা শেখানোর কাজটিও তাই সময়সাপেক্ষ এবং দুরূহ হয়ে পড়ে।

৫. ঘুমানোর সময় নির্ধারণ: বাড়ন্ত শিশুদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা নির্ভর করে তাদের ঘুমের পরিমাণের উপর। বিশেষ করে সঠিক সময়ে ঘুমাতে যাওয়া শিশুদের শেখার ক্ষমতা ও মনোযোগ, অনিয়মিত সময়ে ঘুমাতে যাওয়া শিশুদের চেয়ে বেশি। ইংল্যান্ডের একদল গবেষক সম্প্রতি এমন তথ্য প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ পরিবারেই শিশুদের ঘুমানোর জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নির্ধারণ করা হয় না। বিশেষ করে

আমাদের যৌথ পরিবারগুলোতে এই সমস্যা আরও বেশি। বাসার পরিবেশ তাই এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে শিশুর ঘুমানোয় ব্যাঘাত না ঘটে। আপনার সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে হলে, আপনাকেই আগে জানতে হবে, তাকে কীভাবে লালন-পালন করতে হবে। নিজেদের বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতাগুলো জানিয়ে দিতে হবে, যাতে সে মানসিকভাবে নিজেকে ক্রমাগত বদলাতে থাকা পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য তৈরি করে নিতে পারে। আপনার ব্যবহার আর শেখানো বিষয়গুলোই তার পরবর্তী জীবনের পাথেয়।

Check Also

আকর্ষণীয় ফিগার

আকর্ষণীয় ফিগার পেতে চাইলে যা করবেন

আগেকার দিনে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বলতে বোঝাতো নাদুস-নুদুস চেহারার মানুষ। যুগের সাথে মানুষের চাওয়া-পাওয়া বদলে গেছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *